যেভাবে রাতারাতি কোটিপতি টেকনাফের জামাল

ডেস্ক রিপোর্ট :

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মানি লন্ডারিং মামলার আসামি মানব পাচারকারী চক্রের মূল হোতা জামাল হোসেনকে টেকনাফ থানার শাহপরীর দ্বীপ থেকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। গ্রেপ্তার জামালের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে এক কোটি ৮৩ লাখ টাকার সন্ধান পেয়েছে সংস্থাটি।

মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) শারমিন জাহান এসব তথ্য জানান।

শারমিন জাহান জানান, ২০১৮ সালের ১ সেপ্টেম্বর জামাল হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলার মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত চার্জশিট অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, যা খুব শিগগির কক্সবাজার আদালতে দাখিল করা হবে।

যেভাবে মিলল টাকার সন্ধান

শারমিন জাহান জানান, ২০১৪ সালের ২৩ মে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পাঠানো এক অ্যানালাইসিস রিপোর্ট অনুসন্ধান করেছিলেন দুদকের উপসহকারী পরিচালক মো. সাইদুজ্জামান। অনুসন্ধানকালে তিনি জামাল হোসেনের মানব পাচার (পাচার) সম্পৃক্ত অপরাধ সংঘটনের মাধ্যমে অর্জিত অবৈধ অর্থের সন্ধান পান। জামাল নিজ নামের ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের টেকনাফ শাখায় ২০১৪ সালের ২৩ মে থেকে ২০১৫ সালের ১৪ মে পর্যন্ত সর্বমোট এক কোটি ৮৩ লাখ টাকা জমা করেন। আর জমা করা টাকা বিভিন্ন তারিখে চেকের মাধ্যমে উত্তোলন করার প্রমাণ পাওয়া যায়।

এরপর ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই মো. সাইদুজ্জামান বাদী হয়ে টেকনাফ মডেল থানায় আসামি জামাল হোসেনের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলাটি মানব পাচার সংক্রান্ত এবং অপরাধলব্ধ আয় হওয়ায় এর তদন্তভার দেওয়া হয় সিআইডিকে। জামাল হোসেনকে সেই মামলাতেই গ্রেপ্তার করা হয়।

১৬ জেলা থেকে টাকা আসে ১৩ ব্যাংকে

সিআইডি সূত্রে জানা যায়, আসামি জামাল হোসেন ২০১৩ সালের শেষ দিকে মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়েন। এরপর থেকেই তিনি বিভিন্ন ব্যাংকে মানব পাচার সংক্রান্ত আর্থিক লেনদেন শুরু করেন।

তার নামে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের টেকনাফ শাখায় তিনটি, সাউথইস্ট ব্যাংক লিমিটেডের টেকনাফ শাখায় তিনটি, এবি ব্যাংক লিমিটেডের টেকনাফ শাখায় একটি এবং ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের মোবাইল ব্যাংকিং (রকেট) এ তার নিজ নামে ও একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে ১৩টি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। এসব অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে তিনি প্রচুর অবৈধ অর্থ লেনদেন করেছেন।

সিআইডি জানায়, বাংলাদেশের ১৬টি জেলা থেকে মানব পাচার সম্পৃক্ত টাকা জামালের অ্যাকাউন্টে আসে। তার মধ্যে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের টেকনাফ শাখায় তার ব্যাংক হিসাব নম্বর-২০৫০১৪৭০১০০৩১৩৪১০ তে ২০৪১৪ থেকে ২০১৫ সালে সবচেয়ে বেশি লেনদেন সম্পাদিত হয়। জমাকৃত অর্থ তিনি নিজে, তার চাচাতো ভাই, তার দোকানের কর্মচারী, তার স্ত্রীর বড় ভাইসহ তার মনোনীত ব্যক্তিদের মাধ্যমে ব্যাংক থেকে উত্তোলন করেন।

মানব পাচারের টাকায় যত ব্যবসা

সিআইডির তদন্তকালে আসামি জামাল জানান, মানব পাচারের টাকা দিয়ে তিনি টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ বাজার ইজারা নেন, যা ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত পরিচালনা করেন। বাজার ইজারা নেওয়ার সময় তিনি সাত লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন।

২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি শাহপরীর দ্বীপ জেটি এলাকার করিডোরে গরু কেনা-বেচার ব্যবসা করেন। সেখানে তিনি আট থেকে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেন। এরপর ২০১৫ সাল জামাল ডিস ব্যবসায় এক লাখ ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেন। ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি ১২ লাখ টাকা দিয়ে দুটি ফিশিং বোট কেনেন।

এ ছাড়া তিনি জনি টেলিকম ও জামাল টেলিকম নামের দুটি দোকানে টাকা লোড দেওয়া, বিকাশ, রকেটসহ বিভিন্ন মোবাইল এক্সসরিজে প্রচুর টাকা বিনিয়োগ করেন। জামাল হোসেনের বর্তমান বাড়িটি তিনি ২০১৪ সালে ১০ থেকে ১২ লাখ টাকা খরচ করে নির্মাণ করেন। এর বাইরেও তিনি কয়েকটি মাছের প্রজেক্টে বেশ কিছু টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন।

তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা যায়, আসামি জামাল হোসেন বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার লোকজনদের সমুদ্র পথ দিয়ে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া পাঠান। যদিও তার বিদেশে লোক পাঠানোর বৈধ কোনো লাইসেন্স নেই। অনেক মানুষকে সমুদ্র পথে মালয়েশিয়া পাঠানোর নামে আটক করে রাখেন। এরপর তাদের আত্বীয়-স্বজনদের ফোন করে জামাল টাকা পাঠানোর কথা বলেন। ভুক্তভোগীদের স্বজনরা তখন বাধ্য হয়ে জামালের কাছে টাকা পাঠাতেন। আর টাকা পাওয়ার পরে আটককৃতদের ছেড়ে দিতেন জামাল। এভাবেই ২০১৪ সালের ১৩ মে থেকে ২০১৫ সালের ১৪ মে পর্যন্ত জামালের মানব পাচার সংক্রান্ত আয় দাঁড়ায় এক কোটি ৮৩ লাখ টাকা। যার প্রমাণ পাওয়া গেছে ব্যাংক হিসাবে। এ ছাড়া মামলার তদন্তকালে আাসামি জামালের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা দায়ের করারও তথ্যও পেয়েছে সিআইডির অর্গানাইজড ক্রাইম ইউনিট।